ইনকিউবেটরে বাচ্চা ফোটানোর জন্য জরুরী কিছু তথ্য

১।       ডিম নির্বাচন। ডিম দুই প্রকারের হয়ে থাকে। নিষক্ত এবং অনিষিক্ত ডিম। আমরা বাজার থেকে যে ফার্মের ডিম কিনে থাকি সেগুলো সবই অনিষিক্ত ডিম এগুলো দিয়ে বাচ্চা ফুটবে না। আর বাজারে যেসব দেশী মুরগীর ডিম পাওয়া যায় সেগুলো সাধারণত নিষক্ত ডিম হয়ে থাকে এবং এগুলো দিয়ে ইনকিউবেটরে বাচ্চা ফুটানো সম্ভব। সুতরাং ইনকিউবেটরে ডিম দেবার আগে সেগুলো নিষক্ত ডিম কিনা সেটা নিশ্চত হয়ে নিন। তা না হলে নির্দিষ্ট সময় পর পচা ডিমের গন্ধে আপনার বাড়ী ভরে যাবে।  আর ডিম সংগ্রহের পর সেগুলো রুম তাপমাত্রায় রাখুন। রেফ্রিজারেটরে রাখলে সেগুলো ইনকিউবেটরে দেবার আগে ৪-৫ ঘন্টা রুম তাপমাত্রায় রেখে স্বাভাবিক করে নিন। এক দিন বয়সী কিংবা অনেক পুরনো ডিম পরিহার করা উচিত।

২।       ইনকিউবেটরের তাপমাত্রা ও আদ্রতা নির্বাচন। ৯৯.৫ ফারেনহাইট অথবা ৩৭.৫সেলসিয়াস। এর সামান্য কমবেশী হলে ডিম দেরিতে অথবা তাড়াতাড়ি ফুটবে। যদি তাপমাত্রা খুব কম অথবা অনেক বেশী হয় তাহলে ডিম ফুটবে না।  ডিম ফূটার তিন দিন আগে পর্যন্ত আদ্রতা ৫০-৬০% রাখুন, শেষ তিন দিন আদ্রতা ৭০-৭৫% রাখতে হবে যাতে ডিমের খোলস নরম থাকে এবং খোলস ভেংগে বাচ্চা বেরিয়ে আসতে পারে।

৩।      ইনকিউবেটর প্রস্তুত করণ। ডিম দেয়ার আগে ইনকিউবেটরকে কম পক্ষে ৫-৬ ঘন্টা চালিয়ে তাপমাত্রা ৯৯.৫ ফারেনহাইট অথবা ৩৭.৫সেলসিয়াস এ আনুন। এর মাধ্যমে ইনকিউবেটরের ছোট খাট সমস্যা থাকলে সেটাও ধরা যাবে।

৪।       কিভাবে ডিম রাখবেন। ইনকিউবেটরের ডিম রাখার সময় সরু অংশ নীচের দিকে রাখুন। ডিম রাখার সময় ইনকিউবেটরের তাপমাত্রা কমে যেতে পারে কারন ডিমগুলো কিছু তাপমাত্রা শোষন করবে, ভেতরের বাচায় বাইরে বের হয়ে আসবে অথবা বাইরের বাচাস ভেতরে ঢুকবে। ৫-৬ ঘন্টা পরেও যদি তাপমাত্রা ৩৭.৫সেলসিয়াসে না পৌছে তবে ইনকিউবেটর পরীক্ষা করুন। একবার ডিম দেবার পর ৭ দিনের আগে আর খুলবেন না।  ৭-৮ দিন পর খুলে একটা একটা করে ডিম পরীক্ষা করে দেখুন যে ডিমের ভেতরের ভ্রুন তৈরী হয়েছে কিনা। যেগুলোতে ভ্রূন তৈরী হয়েছে, সেই ডিমগুলো পাশাপাশি রাখুন।

৫।       মাঝে মাঝে ইনকিউবেটরের তাপমাত্রা কমে যায় কেন? যেহেতু  ইনকিউবেটরের হিটার সারাক্ষন অন অবস্থায় থাকে না তাই কিছুক্ষন পর পর ভেতরের তাপমাত্রা কমে যাবে। ভয় পাবার কিছু নেই। ইনকিউবেটর ঠিক থাকলে কিছুক্ষন পর পর হিটার অন হয়ে তাপমাত্রা ঠিক হয়ে যাবে।   এভাবেই ইনকিউবেটর তৈরী করা হয়েছে।

৬।       ভেন্টিলেশন। ভ্রূন তৈরী হবার সময়ে এবং তারপর থেকে বাচ্চা বের হওয়া পর্যন্ত ডিমেরও শ্বাস – প্রশ্বাস নিতে হয়।  ভ্রূনের জন্য বাতাসের তাজা অক্সিজেন খুব জরুরী। প্রথম দিকে কম অক্সিজেন লাগলেও ভ্রূন গুলো বড় হতে থাকলে এবং বাচ্চা বের হবার পর প্রচুর অক্সিজেন লাগে। ডিম রাখার এক সপ্তাহ পর একবার ১-২ ঘন্তার জন্য ভেন্টিলেশন উইন্ডোগুলো খুলে রাখুন যাতে তাজা বাতাস ভেতরে ঢুকতে পারে। এরপর প্রতিদিন বা ২-৩ দিন অন্তর একবার অন্তত ৫-১০ মিনিটের জন্য ভেন্টিলেশন উইন্ডোগুলো খুলে রাখুন। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে শুরু করলে, ভেন্টিলেশন উইন্ডোগুলো সব সময়ের জন্য খুলে দিন।

৭।       ডিম পরীক্ষা করুন। ডিম রাখার ৭ দিন পর একটা একটা করে ডিম নিয়ে আলোতে ধরে পরীক্ষা করুন। আমাদের দেয়া এগ ক্যান্ডল ব্যবহার করুন। যেসব ডিমে ভ্রুন তৈরী হয়নি সেগুলোতে পেন্সিল দিয়ে দাগ দিয়ে আলাদা এক জায়গায় আবার বসিয়ে দিন। ১৪ দিনের মাথায় আবারো শুধুমাত্র দাগ দেয়া ডিম গুলো পরীক্ষা করুন। এখনও যেসব ডিমে ভ্রুন দেখতে পাচ্ছেন না সেগুলো ফেলে দিন, বাকী গুলো আবার ইনকিউবেটরে দিয়ে দিন।  ডিম খুব বেশী নড়াচড়া কিংবা ঝাকুনী দিবেন না। এতে ভ্রুন নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এসময় খুব বেশী সময় ধরে ইনকিউবেটরের দরজা খোলা রাখলে আদ্রতা কমে গিয়ে আগেরবারের ভাল ডিমগুলো ভেতরে ভেতরে শুকিয়ে ভ্রুন মরে যাবে।

৮।      ডিম ঘুরানো বন্ধ করুন। দিম দেবার পর ডিমের ট্রে আপনা আপনি ঘুরতে থাকবে। এটা প্রতি দুই ঘন্টা পর একবার ঘুরবে। ডিম ফুটার তিন দিন আগে থেকে Turning Switch অফ করে দিন এবং সব ডিমকে টার্নিং ট্রে থেকে সরিয়ে হ্যাচিং ট্রেতে রাখুন। ইনকিউবেটরের আদ্রতা বাড়িয়ে দিন আর অপেক্ষা করুন। এই তিন দিন অতি ভয়াবহ জরুরী অবস্থা ছাড়া ইনকিউবেটরের দরজা খুলবেন না।

৯।       হাঁস –মুরগী-কোয়েল বা টার্কির ডিম একসাথে? না কখনো এই কাজটি করবেন না। যেহেতু একেক ডিম একেক সময়ে ফুটবে, তাই বারবার ইনকিউবেটরের দরজা খোলা – বন্ধ করতে গেলে আদ্রতা এবং তাপমাত্রা কমে গিয়ে অনেক ডিম নষ্ট হয়ে যাবে। অবশ্য একটু বুদ্ধি খাটালে এটা সম্ভব। হাঁসের ডিম ২৮ দিন, মুরগী ২১ আর কোয়েলের ডিম ১৮ দিনে ফুটে।  যদি সব ধরনের ডিম একসাথে দিতে চান,  তাহলে প্রথমে হাঁসের ডিম দিন। এর ৭ দিন পর ডিম পরীক্ষার সময় মুরগীর ডিম দিন। তার তিন দিন পর দিন কোয়েলের ডিম রাখুন। এতে করে হাঁস – মুরগী আর কোয়েলের বাচ্চা একই সময়ে ফুটবে। তবে এতেও কিছু  হাঁসের ডিম নষ্ট হতে পারে।

১০।     নির্দিষ্ট দিনেও ডিম ফুটেনি? ঘাবড়াবেন না। অনেক কারনেই ডিম দেরীতে ফুটতে পারে। তাই ১৮, ২১ বা ২৮ দিনে ডিম না ফুটলে আরো ২ দিন অপেক্ষা করুন। এরপরও না ফুটলে কয়েকটা ডিম ভেংগে পরীক্ষা করে দেখুন ভেতরের অবস্থা কি। তারপর চাইলে আরো সর্বোচ্চ ২৪ ঘন্টা অপেক্ষা করুন অথবা না ফোটা ডিম ফেলে দিন। প্রথম প্রথম ইনকিউবেটর ব্যবহারের অনভিজ্ঞতার কারনে কিছু ডিম নষ্ট হতে পারে। আস্তে আস্তে দুই একটি ব্যাচ করার পর আপনার অভিজ্ঞতা আপনাকে অনেক সাহায্য করবে।

১১।     বাচ্চা ফুটছে – কি করবেন? অভিনন্দন আপনাকে। Congratulations. ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলে সেগুলো শুকিয়ে ঝরঝরে হতে দিন। তারপর ওরা নিজের পায়ে দাঁড়াবে। কিচির মিচির করবে। এরপর তাদেরকে উষ্ণ ব্রুডারে রাখুন। খাবার, পানি দিন। ব্রুডার গরম রাখুন। মনে রাখবেন ডিম ফোটার পর ২৪ -৩০ ঘন্টা পর্যন্ত বাচ্চার কোন খাবার বা পানির দরকার নেই। ডিম ভেংগে বাচ্চার ঠোট বের করে উকি দেয়ার ২৪-৪৮ ঘন্টা পর বাচ্চা বের হয়। সব কিছু ঠিক থাকলে বাচ্চারা নিজের খোলস নিজেই ভেংগে বের হবে কোন বাইরের সাহায্য দরকার নেই।  কিছু বাচ্চা হয়তো ডিমের খোলস ভেংগে বের হতে পারছে না। তাদেরকে প্রকৃতির উপর সমর্পন করুন অথবা ৪৮ ঘন্টা অতিক্রান্ত হয়ে গেলে আলতো হাতে খোলাস ভেংগে বের করে আনুন। ভাগ্য ভাল হলে সেগুলো বেঁচে যেতে পারে।

১২।     বাচ্চার খাবার। বাজারে বিভিন্ন কোম্পানীর খাবার কিনতে পাওয়া যায়। এক দিন বয়সী বাচ্চার জন্য উপযোগী খাবার কিনলেও প্রথম ৮-১০ দিন সেগুলোকে পাটায় পিষে কিংবা ব্লেন্ডারে একটু গুড়ো করে দিন। ব্রয়লারের বাচ্চার জন্য বানিজ্যিক খাবার উপযোগী হলেও আমাদের দেশীইয় মুরগী কিংবা কোয়েলের জন্য এগুলোর আকার বা ( Size) অনেক বড় হয়ে যায়। তাই প্রথম দিকে ভেংগে দিতে হয়।

১৩।     পানি। বাচ্চাকে অতি ঠান্ডা কিংবা অতি গরম পানি দেবেন না। কুসুম গরম পানি সবচে ভাল। প্রতিদিন পানির ট্রে ধুয়ে পরিস্কার করুন। ফোটানো পানি দিন।

১৪।     কতিপয় সমস্যা, কারণ ও প্রতিকার।

ক।      নির্দিষ্ট দিনের আগেই বাচ্চা ফুটে গেছে। তাপমাত্রা অনবরত ৩৭.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশী থাকলে কিংবা ডিম ইনকিউবেটরে রাখার আগে থেকেই ঐ তাপমাত্রায় রাখা হলে ডিম আগে ফুটে যেতে পারে।  ইনকিউবেটরে ডিম দেয়ার আগে ডিম যেন ২০-২৫ ডিগ্রীর বেশী তাপমাত্রাইয় রাখা না হয় সেটা নিশ্চত করুন।

খ।       নির্দিষ্ট দিনের পরে বাচ্চা ফুটেছে। তাপমাত্রা অনবরত ৩৭.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের কম থাকলে এটা হতে পারে।

গ।       পরিপূর্ন ভ্রুন, ঠোট বের করেছে কিন্তু মারা যাচ্ছে। নিম্ন আদ্রতা এবং  কম ভেন্টিলেশনের কারনে অথবা ডিমের নীচু দিক উপর করে ট্রে তে রাখলে এটা হতে পারে।(ডিমের মোটা অংশ উপর ডিকে থাকবে)।

ঘ।       পরিপূর্ন ভ্রুন, ঠোট বের করতে পারেনি এবং মারা যাচ্ছে। অতি বেশী আদ্রতা, কম ভেন্টিলেশনের কারনে অথবা ডিমের নীচু দিক উপর করে ট্রে তে রাখলে এটা হতে পারে।(ডিমের মোটা অংশ উপর ডিকে থাকবে)। এছাড়া ভ্রুন তৈরী হবার সময়ে ডিমের ট্রে অনেকক্ষন না ঘুরে এক পজিশনে থাকলেও এটা হতে পারে।

ঙ।       বাচ্চা বের হয়েছে, কিন্তু নাভী উম্মুক্ত এবং রক্তক্ষরণ। অতিরিক্ত তাপমাত্রা।

চ।       ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবার সময়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য। সাধারণত ৮০-৯০% ডিম একই দিনে ৪-৫ ঘন্টার ব্যবধানে ফুটবে। বাকী ডিম পরবর্তী ৭-৮ ঘন্টা আগে অথবা পরে ফুটবে। যদি এমন দেখা যায় যে  কিছু ডিম এখন, কিছু ডিম একদিন পর, কিছু ডিম ২ দিন পর ফুটেছে, তাহলে বুঝতে হবে যে, ইনকিউবেটরের ভেতরে কিছু জায়গায় গরম কিছু জায়গায় ঠান্ডা আবহাওয়া রয়েছে। যেসব জায়গা গরম সেগুলোর ডিম আগে ফুটে যাচ্ছে আর যেসব জায়গা ঠান্ডা, সেসবের ডিম পরে ফুটছে।

ছ।       বাচ্চা খোলসের সাথে আটকে যাচ্ছে।         অতিরিক্ত তাপমাত্রা এবং নিম্ন আদ্রতা অথবা বার বার ইনকিউবেটরের দরজা খোলা হলে এমনটা হতে পারে।

জ।      বিকলাংগ বাচ্চা। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে কিছু বাচ্চা বিকলাংগ হতেই পারে যার পরিমান সংখ্যায় ১-২% এর বেশী হবার কথা নয়। যদি এর থেকে বেশী হয় তাহলে অতিরিক্ত তাপমাত্রা, নিম্ন আদ্রতা অথবা ডিম উলটা করে রাখার ফলে এমনটা হয়েছে।

ঝ।      দুর্বল বাচ্চা।   প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে কিছু বাচ্চা দুর্বল হতেই পারে যার পরিমান সংখ্যায় ১-২% এর বেশী হবার কথা নয়। যদি এর থেকে বেশী হয় তাহলে অতিরিক্ত তাপমাত্রা, নিম্ন আদ্রতা অথবা ডিম উলটা করে রাখার ফলে এমনটা হয়েছে।

ঞ।     ভ্রুনের স্বাভাবিক বৃদ্ধি কিন্তু বাচ্চা ফোটেনি।  ডিম ঠিক মত উলটানো হয়নি, তাপমাত্রা সঠিক ছিল না, খারাপ ভেন্টিলেশন, রোগ বালাই কিংবা দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যুৎ না থাকলে এটা হতে পারে।

ট।       সামান্য ভ্রুনের গঠন, তারপর মারা গেছে।  ব্যাকটেরিয়া সংক্রমন, ইনকিউবেটরে দেবার আগে অতি ঠান্ডা কিংবা অতি গরম তাপমাত্রায় ডিম সংরক্ষন, অপরিচ্ছন হাত, অপরিচ্ছন্ন ইনকিউবেটর, ইনকিউবেটরের আভ্যন্তরীন তাপমাত্রা হঠাত কম বেশী হলে কিংবা দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যুৎ না থাকলে এটা হতে পারে।

ঠ।       ভ্রুন গঠিত হয় নি। অনিষিক্ত ডিম, ইনকিউবেটরে বসানোর আগে অতিরিক্ত নড়াচড়ার ফলে ডিমের  ভেতরে কুসুম ভেংগে যাওয়া কিংবা অনেক দূর থেকে ডিম আনার পর যথাযথ রেষ্ট না দিয়ে ইনকিউবেটরে ডিম বসালে এটা হতে পারে।

4 thoughts on “ইনকিউবেটরে বাচ্চা ফোটানোর জন্য জরুরী কিছু তথ্য

  1. zahid says:

    ভাই আমার একটা এনালগ মেশিন কিনছ ই ডিম ফুটছে না আপনার সাথে কন ভাবে যোগাযোগ করা যাবে আমার নাম্বার ০১৯১৬৭৪৮৩১৫ দয়া করে যোগাযোগ করুনplz

    Like

    • kiengr says:

      আপনি কি এখনো ডিম ফূটাতে পারেন নাই? দয়া করে আমার ফেস বুকে আসুন। সেখানে আপনার সমস্যা শুনে সমাধান দিতে চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

      Like

    • kiengr says:

      প্রথম ২৪ দিন ৫০-৫৫%। এরপর শেষ ৩ দিন অর্থাৎ ২৫ থেকে ২৮ দিনে বাচ্চা ফোটা পর্যন্ত ৭০-৭৫% আদ্রতা দরকার।

      Like

Leave a comment